মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৯ অপরাহ্ন
বাঘা (রাজশাহী) প্রতিনিধি,
বাঙালীর সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে মেলার গন্ধ। কখনও ঋতু কখনও কৃষি কখনও নববর্ষ কখনও ঈদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এ মেলা। বাংলার ঐতিহ্যবাহি আকর্ষণ হলো পল্লী মেলা। এমন একটি ঈদ মেলার আয়োজন করা হয় রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। ঈদ আনন্দের সঙ্গে বাড়তি আনন্দ যোগাতে ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজশাহীর বিভাগীয শহর থেকে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে বাঘা উপজেলা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে ঐতিহ্য হয়ে মিশে আছে ঈদুল ফিতরের ঈদে অনুষ্ঠিত বাঘার এই ঈদ মেলা। তাই এই মেলা এখানকার মানুষের কাছে গভীর আগ্রহের। ঈদের দিন ঘনিয়ে আসায় আনন্দের সঙ্গে বাড়তি উৎসবের আমেজে মেতে ওঠে আশেপাশের উপজেলার মানুষ। শুধু বাঘা নয়, আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার মানুষের ঈদ আনন্দের সঙ্গে বাড়তি আনন্দ যোগায় ঐতিহ্যবাহী এই ঈদমেলা। এমনকি সীমান্তবর্তী এলাকার যাদের স্বজনরা সীমান্তের ওপারে আছেন,তারা বছরের এই সময়টা বেছে নেন একে অপরের সাথে দেখা করার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাদের বাস তারাও ছুটে আসেন।
বিশেষত ১৫ রোজার পর পরই শুরু হয় মেলার আয়োজন। ২সপ্তাহের অনুমতি সাপেক্ষে মেলা মূলত ঈদের আগের দিন থেকেই শুরু হয়। চলে টানা এক মাস। এবারো মেলার জন্য ওয়াকফ এস্টেটের মাঠ ইজারা দেয়া হয়েছে ২০ লক্ষ ১ হাজার টাকা। মেলার আয়োজন ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
ধর্মীয় আদর্শের দিক-নির্দেশনার মহৎ পুরুষ আব্বাসীর বংশের হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রঃ)ও তার ছেলে হযরত আব্দুল হামিদ দানিশমন্দ (রঃ) এর সাধনার পীঠস্থান বাঘা। আরবি শওয়াল মাসের ৩ তারিখ আধ্যাত্বিক দরবেশের ওফাত দিবসে, ধর্মীয় ওরস মোবারক উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঘার ওয়াকফ এষ্টেটের বিশাল এলাকা জুড়ে বছর বছর পবিত্র ঈদুল ফিতরে অনুষ্ঠিত হয় মেলা। সেই মেলা বাঘা ঈদ মেলা নামে খ্যাত। লাখো মানুষের মিলন মেলায় পরিনত হয় এ ঈদ মেলা। ঈদুল ফিতরের উৎসবকে কেন্দ্র করে এত বড় মেলা দেশের অন্য কোথাও হয় বলে জানা যায়নি।
ধর্মীয় উৎসব হলেও সব সম্প্রদায়ের লোকজন আসেন এ মেলায়। মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন রকমের পণ্য ব্যবসায়ী সব মিলে প্রায় ৩ হাজার দোকানি তাদের পসরা সাজিয়ে বসে মেলায় কেনা-বেচা করার জন্য। গভীর রাত পর্যন্ত পণ্য বেচা-কেনা হয়। মেলায় পাওয়া যায় সব ধরনের মিষ্টি, বাচ্চাদের খেলনা, মনোহারি সামগ্রী, লৌহজাত দ্রব্য, কাঠের সামগ্রী, আলনা, চেয়ার টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, খাট, পালং, শোকেচ এবং মাটির হাঁড়ি পাতিল প্রভৃতি। মাজরের প্রধান গেটের দুই সারিতে বসে কসমেটিকসহ বিভিন্ন রকমের খেলনা জাতীয় পণ্য নিয়ে। বাঁশ, বেত , ষ্টীল, কাঠের তৈরী জিনিসের অপূর্ব সমারোহে পরিপূর্ণ হয় বাঘা কলেজ মাঠ। লোহার কর্মকার ও মৃৎ শিল্পীরা মেলায় নিয়ে আসেন মাটি ও লোহার তৈরি বিচিত্র জিনিস পত্র। নাটোরের বনলতা ও সদরঘাটের ঐতিহ্যবাহি পান দৃষ্টি কাড়ে আগত লোকজনের। ভেসজ ও ফল ফুলের নার্সারীর দোকান দেশ বরেণ্য রাজনৈতক নেতা, কবি,সাহিত্যিক, গায়ক অভিনেতা ও খেলোয়াড়দের ফটো সব ধর্মীয় পুস্তক বিক্রেতারা খন্ড খন্ড দোকান সাজিয়ে বসেন মেলার চারদিকে। খানকা বাড়ির মধ্যে রাতভর চলে সামাকাওয়ালি,মারিফতি গান,ঈদগাহ মাঠে লটারি স্কুল মাঠে যাত্রা,সার্কাস,পুতুলনাচ।
মেলার পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা আব্দুল হান্নান (৯৫) জানান, প্রথম দিকে লোক সংখ্যা কম হলেও কালের বিবর্তনে মেলার পরিধি ও লোক সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। মূলত ধর্মীয় ওরশকে কেন্দ্র করেই মেলার আযোজন। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ঈদুল ফিতরের ঈদ মানেই বাঘার মেলা। তিনি জানান, বাঘা ও এর আশপাশের অনেকের বিয়ে হয়েছে ভারতে। বছরের সব সময় যাতায়াত না থাকলেও ঈদুল ফিতরে বাঘার মেলাকে কেন্দ্র করে তারাও আসেন স্বজনদের সাথে দেখা করতে। বাবার কাছ থেকে শোনা গল্পের কথা জানিয়ে আব্দুল হান্নান বলেন,বাঘার মেলাকে ঘিরে ঈদের আগের দিন ভারত থেকে প্রচুর লোকজন আসতো। জামাইসহ মেয়েরা আসতো বাপের বাড়ি। সেই রীতি অনুযায়ী এখনো মেলা ঘুরে কয়েকদিন পর আবার ফিরে যান। ভারতের সাগরপাড়া থেকে বাঘায় ভাইয়ের বাড়িতে এসেছেন আনারুল। ঈদুল ফিতরের নামাজ ও মেলা ঘুরে ফিরে যাবেন তিনি। তার মতো ভারত থেকে আসা লালনভক্ত লাল মিঞা (৭০)। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এবার তিনি একাই এসেছেন। থাকছেন মাজার এলাকায় নির্মানাধীন ঘরে। মেলায় এলে অনেকের সাথে দেখা হয় তার। বেঁছে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত এই সুয়োগ হারাতে চাননা তিনি। ওরশ উৎসবকে ঘিরে ঈদুল ফিতরের ঈদে অনুষ্ঠিত মেলা তাকে আগের দিনগুলোতে ফিরে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ঈদের আগের দিন আরো কয়েকজন আসবে বলে জানান তিনি। ওরশ শেষে তাদের সাথে ফিরে যাবেন।
বাঘা মাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব খন্দকার মুনসুরুল ইসলাম (রইশ) জানান, প্রতি বছরই মেলার জৌলুস বাড়ছে। বাড়ছে লোক সমাগম। মূলত বছরের এই দিনটিতে মেয়ের পরিবারের লোকজন জামাইয়ের পরিবারকে আমন্ত্রন জানিয়ে থাকেন। মেলা যেমন লাখো মানুষের মিলন মেলায় পরিনত হয়, তেমনি বাঘা ও আশেপাশের উপজেলার পরিবারগুলোতেও বসে স্বজনের মিলন মেলা। দেশের দুর দুরান্ত থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষদের কেই আসে নামাজ আদায় করতে,কেউ আসে ওরশে আবার কেউ আসে মেলা দেখা ও আনন্দ উপভোগ করার জন্য। প্রতি বছর মেলা থেকে যে টাকা আয় হয়,সেই টাকা মাজারের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়।
দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আগত যাত্রীদের কেউ থাকেন, খানকা বাড়ীর ভেতরে, কেউ স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বারান্দায়। ওরস উপলক্ষে সারারাত চলে ভক্তদের জিকির, সামা কাওয়ালি।
উল্লেখ্য,প্রায় ৫০০ বছর আগে সুদূর বাগদাদ থেকে হযরত শাহদৌলা (রঃ) ৫ জন সঙ্গীসহ বাঘা এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। বসবাস শুরু করেন, পদ্মা নদীর কাছে কসবে বাঘা নামক স্থানে। আধ্যাত্মিক শক্তির বলে ঐ এলাকার জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারের ব্যাপক সাফল্য লাভ করেন।